পুকুরের উর্বরতা বা জৈব উৎপাদন নির্ভর করে পুকুরের পানির ভৌত- রাসায়নিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ওপর। পুকুরের ভৌত-রাসায়নিক অবস্থাকে প্রভাবিত করে এমন উপাদানগুলো নিম্নরূপ-
পানির গভীরতাঃ উষ্ণমন্ডলীয় অঞ্চলের গভীরতার কারণে সূর্যালোকের প্রভাবে পানিতে তিনটি স্তরের সৃষ্টি হয়। যথা- ইপিলিমনিয়ন (উপরের স্তর), থার্মোক্লাইন (মধ্য স্তর) এবং হাইপোলিয়নিয়ন (নিচের স্তর)। বাংলাদেশের অধিকাংশ পুকুরগুলোর গভীরতা ২-৩ মিটার। ফলে হাইপোলিমনিয়ন স্তরটি দেখা যায় না। উপরের স্তরই মাছ চাষের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাথমিক খাদ্য উৎপাদনে সহায়ক। নার্সারি পুকুরের গভীরতা বেশি হলে চিংড়ির পিএল পানির চাপ সহ্য করতে পারে না। পিএল অগভীর পানিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। নার্সারি পুকুরের গভীরতা ৭৫-৯০ সেমি (২.৫-৩.০ ফুট) হলে ভালো হয়।
তাপমাত্রাঃ পানির তাপমাত্রার সাথে পুকুরের প্রাথমিক উৎপাদন এবং গলদা চিংড়ির দৈহিক বৃদ্ধি সরাসরি সম্পর্কিত। গলদা চিংড়ির পোনা উৎপাদনে সহায়ক তাপমাত্রা ২৫-৩১° সে.।
সূর্যালোকঃ সূর্যালোকের প্রাপ্যতা ও প্রখরতার ওপর সালোকসংশ্লেষণ নির্ভরশীল যা থেকে পুকুরের প্রাথমিক উৎপাদন ও অক্সিজেন সৃষ্টি হয়। গলদা নার্সারি পুকুরে দৈনিক কমপক্ষে ৬-৮ ঘন্টা সূর্যালোক পড়া আবশ্যক।
অক্সিজেনঃ পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের উৎস প্রধানত দুটি-
তাপমাত্রা, লবণাক্ততা, অন্যান্য গ্যাসের আংশিক চাপ বাড়ার সাথে সাথে পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। বায়ু চাপ বাড়লে অক্সিজেনের দ্রবণীয়তা বাড়ে। নার্সারি পুকুরের অক্সিজেনের মাত্রা ৫-৭ পিপিএম হলে ভালো হয়।
অ্যামোনিয়াঃ মাছ ও চিংড়ির বর্জ্য, অভুক্ত খাদ্য, বিভিন্ন দ্রব্যের পচন ইত্যাদির ফলে অ্যামোনিয়ার সৃষ্টি হয়। যার আধিক্য গলদা নার্সারির জন্য ক্ষতিকর। অআয়নিত অ্যামনিয়ার মাত্রা ০.০২৫ মিগ্রা/লিটারের বেশি হওয়া উচিত নয়।
নাইট্রাইটঃ এটি ব্যাকটেরিয়া দহনের ফলে অ্যামোনিয়া ও নাইট্রাইটের মধ্যবর্তী অবস্থা। পুকুরের তলার পচা পদার্থ বেড়ে গেলে অক্সিজেনহীন অবস্থায় ব্যাকটেরিয়া নাইট্রেটকে নাইট্রাইটে পরিণত করে। নাইট্রাইটের খুব স্বল্পমাত্রাও গলদা চিংড়ির জন্য অত্যন্ত বিষাক্ত। পানিতে নাইট্রাইটের মাত্রা ০.১ মিগ্রা/লিটারের কম থাকা উচিত।
কার্বন ডাই-অক্সাইডঃ পানিতে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের উৎস প্রধানত জৈব পদার্থের পচন ও জলজ জীবের শ্বাস প্রশ্বাস। মুক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড পানির পিএইচ এর মান ৪.৫ পর্যন্ত নামাতে পারে। পানিতে ১২ মিগ্রা/লি যুক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড গলদা চিংড়ির জন্য ক্ষতিকর নয়। কার্বন-ডাই-অক্সাইডের বিষাক্ততা অক্সিজেনের মাত্রার ওপর নির্ভশীল। পানিতে এ গ্যাস বেশি থাকলে জলজ প্রাণির অক্সিজেন গ্রহণ করার ক্ষমতা কমে যায়।
ক্ষারত্ব ও খরতাঃ পানিতে উপস্থিত কার্বনেট, বাই কার্বনেটের ঘনত্বই ক্ষারত্ব এবং ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম এর যৌথ ঘনত্বই হচ্ছে খরতা। গলদা চিংড়ি চাষের জন্য হালকা খর পানি সবচেয়ে ভাল। পানির ক্ষারত্ব ও খরতার মান ২০ মিগ্রা/লি কম বা খুব বেশি বেড়ে গেলে বাফারিং ক্ষমতা কমে যায়, প্রাথমিক উৎপাদন কমে যায়, সারের কার্যকারিতা কমে যায়, গলদা চিংড়ি সহজেই অম্লতা ও অন্যান্য বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। ক্ষারত্ব ও ক্ষরতার মান ৪০-২০০ মি.গ্রা./লি হওয়া উচিত।
পিএইচঃ পিএইচ হচ্ছে কোন বস্তুর অম্লতা ক্ষারত্বের পরিমাপক। পানির পিএইচ বলতে পানির অম্লতা বা ক্ষারত্বের অবস্থা বুঝায় যা ১ হতে ১৪ পর্যন্ত বিস্তৃত। নিরপেক্ষ মান ৭ দ্বারা নির্দেশিত হয়। পিএইচ এর মান ৭ এর কম হলে অম্লতা এবং ৭ এর বেশি হলে ক্ষারত্ব নির্দেশ করে। গলদা চিংড়ির নার্সারির ক্ষেত্রে পিএইচ এর মান খুই গুরুত্বপূর্ণ। গলদা চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে পানির পিএইচ এর মান ৭.৫-৮.৫ এর মধ্যে থাকা সবচেয়ে ভালো।
লবণাক্ততাঃ গলদা চিংড়ি মিঠা পানির চিংড়ি, তবে অল্প লবণাক্ততায় গলদা চিংড়ির চাষ হয়। চাষের ক্ষেত্রে পানির লবণাক্ততা ০-৪ পিপিটি হওয়া উচিত।